আজকাল বিশ্বের দেশগুলোকে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভাগ করা হয়। এই দেশগুলোকেই আবার শিল্পোন্নত ও কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে পরিচিত করা হয়।
শিল্পোন্নত দেশগুলো কৃষিতেও উন্নত। এ সকল দেশ তাদের কৃষিকে উন্নত করে শিল্পে পরিণত করেছে। অপরদিকে ‘কৃষিনির্ভর’দেশের সরকার বা কৃষক সমাজ শুধু অর্থনৈতিক কারণে উন্নত কৃষি প্রযুক্তি আত্মস্থ ও ব্যবহার করতে পারছে না। আসল কথা হচ্ছে আজ অনুন্নত দেশগুলো কৃষিতে অনুন্নত এবং উন্নত দেশগুলো কৃষিতেও উন্নত।
স্বাধীন বাংলাদেশে কৃষির অগ্রগতি : স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রাকালে দেশে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, একটি কৃষি কলেজ, একটি ভেটেরিনারি ট্রেনিং ইন্সটিটিউট ও কয়েকটি কৃষি সম্প্রসারণ ট্রেনিং ইন্সটিটিউট ছিল । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কৃষির প্রতি অসামান্য দূরদর্শিতায় স্বাধীন বাংলাদেশে কৃষির উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BINA), ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BARC), ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (BJRI), ১৯৭২ সালে তুলা উন্নয়ন বোর্ড (CDB), ১৯৭৪ সালে ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট (SRI), ১৯৭৩ সালে মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (FDC) সহ কৃষি বিষয়ক অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয় । পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI), ১৯৮৫ সালে কৃষি তথ্য সার্ভিস (AIS), ১৯৮৬ সালে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী (SCA), ১৯৯৬ সালে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেম (NARS) ও ২০০৭ সালে ‘Krishi Gobeshona Foundation' স্থাপিত হয়। কৃষি ব্যবস্থাপনা ও গবেষণার উন্নয়নকল্পে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যে যথাক্রমে ‘Integrated Pest Management (IPM)' ও 'National Agricultural Technology Programme (NATP) ' উল্লেখযোগ্য । কৃষিকে অধিকতর পরিবেশবান্ধব করার জন্য সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) সহ উত্তম কৃষি কার্যক্রমে কৃষকগণকে উৎসাহিত ও দক্ষ করে তোলার জন্য বিবিধ কার্যক্রম চালু রয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক ধানের ১০৫টি জাত এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতালগ্নের তুলনায় প্রায় ৩০% কম আবাদী জমিতে তখনকার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি জনসংখ্যার বাংলাদেশ আজ উদ্বৃত্ত প্রধান খাদ্য (ধান) উৎপাদনে সক্ষম । কৃষি শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশে বর্তমানে আটটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সাইন্স বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। এর পাশাপাশি প্রায় সকল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি ও পশুপালন অনুষদ চালু আছে। বর্তমানে সকল কৃষি ফসলের জন্য বিশেষায়িত গবেষণাগার রয়েছে । প্রতি বছর শহর ও গ্রামাঞ্চলে কৃষি মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
কৃত্রিম রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য সবুজ সার এবং কম্পোস্ট সার তৈরি ও ক্ষেতে প্রয়োগ, কেঁচো জাত সার বা ভার্মিকম্পোস্ট প্রয়োগ সংক্রান্ত প্রযুক্তি কৃষকদের হাতে পৌঁছানো হচ্ছে । গবাদি পশুর খাদ্য ঘাটতি মেটানোর জন্য উন্নত গো খাদ্য উৎপাদন, ঘাস প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পোল্ট্রি ও মৎস্য খাদ্য তৈরিতে এখন বিপুল অগ্রগতি হয়েছে। দেশে পোল্ট্রি একটি কৃষি শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বাজারে মাছের একটা বড় অংশ এখন আসছে চাষকৃত মাছ থেকে। প্রতি বছর বৃক্ষরোপণ সরকারিভাবে উৎসাহিত করায় কৃষি বনায়ন ও সামাজিক বনায়নের দিকে কৃষকরা আকৃষ্ট হচ্ছেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষা সম্প্রসারিত হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী কৃষি স্নাতক ডিগ্রীধারীদের ১ম শ্রেণির পদমর্যাদা দান করেন। বায়োটেকনোলজি বা জীবকৌশল বিজ্ঞানে অগ্রগতি বাংলাদেশের কৃষিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশি বিজ্ঞানী কর্তৃক পাটের জেনেটিক ম্যাপ আবিষ্কার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, অর্থাৎ বাংলাদেশে কৃষির আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছে।
ভারতের কৃষি : ভারত একটি বৃহৎ ও ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের দেশ। ভারতের কিছু মরু অঞ্চল ছাড়া সমগ্র পার্বত্য ও সমতল অঞ্চলই কৃষিপ্রধান। কৃষি পরিবেশেও দেশটি বৈচিত্র্যময়। ফলে শস্য, ফুল, ফল, সবজি, মাংস, দুধ, ডিম এমন কোনো কৃষিজ পণ্য প্রায় নেই যা ভারতে উৎপন্ন হয় না কিংবা বাজারে পাওয়া যায় না। ভারতের কৃষিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শুধু ভারতের কৃষি ব্যবস্থার কাজে লাগছে না, বিশ্বও উপকৃত হচ্ছে । ভারতীয় কৃষিজ পণ্যের অন্যতম আমদানিকারক দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ।
চীনের কৃষি : পরিকল্পিত উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার সুবিধাগুলো চীনের কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ জনসংখ্যার দেশ হলেও চীনে খাদ্য ঘাটতির কথা শোনা যায় না। প্রতি হেক্টরে সর্বোচ্চ পরিমাণ ধান, গম, ভুট্টা উৎপাদনের ক্ষমতা চীনা কৃষক ও বিজ্ঞানীদের কঞ্জায় রয়েছে। হাইব্রিড ধান বীজের জনক চীন। এখন পর্যন্ত চীন থেকেই সবচেয়ে বেশি হাইব্রিড ধান বীজ আমাদের দেশে আমদানি হয়। চীনা প্রযুক্তি শেখা ও আমাদের মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করা জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে।
ভিয়েতনামের কৃষি : ভিয়েতনামের অগ্রগতিতে তাদের কৃষক সমাজ ও কৃষির অবদান বিরাট। বিশেষ করে বিশ্বের অন্যতম প্রধান চাল রপ্তানিকারক দেশ আজ ভিয়েতনাম। কৃষি প্রযুক্তি বিকাশে গত কয়েক বছরে এদের সাফল্য বিস্ময়কর। ওদের কাছে আমাদের শেখার রয়েছে অনেক।
কৃষির উন্নয়নের বিষয়টি দেশ বা অঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়ে আজ আন্তর্জাতিক বা বৈশ্বিক গুরুত্ব লাভ করেছে। এই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে যে প্রতিষ্ঠান বিশ্বজুড়ে কাজ করে তার নাম “খাদ্য ও কৃষি সংগঠন” (Food and Agriculture Organization, FAO)। এ ছাড়াও রয়েছে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের (International Rice Research Institute, IRRI, Phillipines) মতো বিশেষ ফসলভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ। আমাদের দেশের কৃষি উন্নয়নে এই প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
কাজ : ১. শিক্ষার্থীরা একক কাজ হিসাবে বাংলাদেশের কৃষির অগ্রগতি সম্পর্কে একটি অনুচেছদ খাতায় লিখবে এবং শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে। ২. কৃষির আধুনিকায়ন মানুষের জীবনযাত্রায় কীভাবে প্রভাব ফেলছে তার একটি বর্ণনা লিখে শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে। |
আরও দেখুন...